যেভাবে এলো এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক| 95 MASK HISTORY

N95 MASK
N95 MASK 
যেভাবে এলো এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক

করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে এন নাইন্টি ফাইভ মাস্কের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এটি খুব ভালভাবেই মুখাবয়বের সাথে খাপ খেয়ে যায় এবং খুব কার্যকরভাবে এটি বাতাসে ভাসমান কণাকে ছাঁকতে পারে। সাধারণ মাস্ক থেকে শুরু করে ইতিহাসের বাঁক বদল করে কীভাবে এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক তৈরি হল সেই বিষয়ে সবিস্তারে জানাতেই এই লেখা।

দুর্গন্ধ তত্ত্ব এবং মাস্কের ব্যবহার
মানুষ যখন মাস্ক ব্যবহার করা শুরু করে তখন বাতাসে ভাসমান ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া যে মানুষকে অসুস্থ করতে পারে এই সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। এই মতটি প্রকাশ করেন ক্রিসটোস লিনটেরিস, যিনি মেডিক্যাল মাস্কের ইতিহাস বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ।

১৭২০ সালে মারসেয়ের আঁকা চিত্র থেকে দেখা যায়, কবর খননকারী এবং অন্যান্য লোকজন যারা মরদেহ ঘাঁটাঘাঁটি করত, তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখত। মারসেয় তখন বিউবোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত ছিল। লিনটেরিসের মতে, লোকজন তখন ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কাপড় দিয়ে মুখ এবং নাক ঢাকত না। বরং তাদের বিশ্বাস ছিল, রোগসমূহ যেমন, প্লেগ ছিল দুর্গন্ধ যা ভূপৃষ্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়। এই কারণেই দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য তারা কাপড় দিয়ে মুখ ও নাক ঢাকত।

এই দুর্গন্ধ তত্ত্বের ফলে ১৬০০ সালে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে একধরনের প্লেগ মাস্ক ব্যবহার করা হত। এই প্লেগ মাস্ক মূলত ব্যবহার করত ডাক্তাররা, যারা প্লেগ শনাক্ত করতেন। তখনকার ডাক্তাররা একটি লাঠি দিয়ে মৃদু টোকা দিয়ে সংক্রমিত রোগীদের শনাক্ত করতেন। এই দীর্ঘকায় মাস্কগুলো ছিল বড় পাখির ঠোঁটের মতো। মাস্কগুলোর শেষ প্রান্তে দুটি নাসারন্ধ্রের প্রবেশদ্বার ছিল যা সুগন্ধি দিয়ে পূর্ণ করা যেত। লোকজন মনে করত, প্লেগের দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে তারা প্লেগ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। লিনটেরিস বলেন, "মানুষের এই ধারণা উনিশ শতক শুরুর দিক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।"

১৮৭০ সালের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা ব্যাক্টেরিয়া সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। অণুজীব বিদ্যার বিকাশের সাথে দুর্গন্ধ তত্ত্বের বিলুপ্তি ঘটে।

সার্জিক্যাল মাস্ক
১৮৯৭ সালে ডাক্তাররা সর্বপ্রথম সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করা শুরু করেন। কিন্তু এই সার্জিক্যাল মাস্ক বাতাসে ভাসমান কণা ছাঁকার কাজে তখন ব্যবহার হত না। তারা এটি ব্যবহার করতেন যাতে সার্জারি চলাকালে নিজেদের হাঁচি-কাশির ফলে সৃষ্ট কোনো তরলের ফোঁটা রোগীর ক্ষতে না পড়ে ।

১৯১১ সালে ম্যানচুরিয়াতে এন্টি প্লেগ মাস্ক পরিহিত স্বাস্থ্য কর্মীরা, Image source: CRASSH, The University of Cambridge
১৯১১ সালে মাঞ্চুরিয়াতে এন্টি প্লেগ মাস্ক পরিহিত স্বাস্থ্য কর্মীরা; Image source: CRASSH, The University of Cambridge
আধুনিক রেস্পিরেটর
১৯১০ সালের শরৎকালে মাঞ্চুরিয়াতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে যা বর্তমানে উত্তর চীন নামে পরিচিত। লক্ষণ দেখা দেওয়ার ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শতভাগ রোগী মারা যেত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চীনের রাজকীয় আদালত একজন তরুণ ডাক্তারকে নিয়োগ করেন যার নাম লিয়েন তেহ উু। ক্যামব্রিজ থেকে মেডিসিনের উপর পড়াশোনা করেন তিনি।

উু প্লেগ আক্রান্ত একজন রোগীর ময়নাতদন্ত করে নির্ণয় করেন, প্লেগ মাছি দ্বারা ছড়ায় না, ছড়ায় বাতাসের মাধ্যমে। তিনি পাশ্চাত্য দুনিয়ায় যে ধরনের সার্জারি মাস্ক দেখেছিলেন তার চেয়ে আরও শক্ত প্রকৃতির মাস্ক তৈরি করেন। সূতি বস্ত্র এবং গজ দিয়ে তিনি এই মাস্কটি তৈরি করেন যা খুব দৃঢ়ভাবে মুখের চারপাশ ঢাকতে পারত। শ্বাসগ্রহণ প্রক্রিয়া বিশোধনের জন্য কয়েক স্তরের কাপড়ও যোগ করা হয়েছিল তার মাস্কটিতে। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, কিন্তু কয়েকজন ডাক্তার এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।

তৎকালীন সময়ে জেরাল্ড মেনসি নামে একজন বিখ্যাত ফরাসি ডাক্তার ছিলেন। উু তার তত্ত্ব মেনসিকে ব্যাখ্যা করে বলেন, "প্লেগ বায়ুবাহিত এবং নিউমোনিয়াঘটিত রোগ।" মেনসি উুর তত্ত্ব শুনে তাকে বেশ অপমান করেন। শুধু তা-ই না, নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে উুর উদ্ভাবিত মাস্ক না পরে হাসপাতালে থাকা একজন প্লেগ রোগীর কাছে যান তিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাত্র দু'দিনের মধ্যে এই প্লেগে আক্রান্ত হয়েই মারা যান মেনসি। এই বিখ্যাত ঘটনাটি তখন লোকমুখে বেশ ছড়িয়ে পড়ে।
লিনটেরিস বলেন, "ওই অঞ্চলের অনেক ডাক্তার খুব দ্রুততার সাথে নিজস্ব মাস্ক তৈরি করছিল। কিন্তু তাদের তৈরি মাস্ক ছিল খুব অদ্ভুত ধরনের ছিল।" উুর তৈরি মাস্ক ব্যাকটেরিয়া থেকে মাস্ক ব্যবহারকারীদের রক্ষা করার পরীক্ষায় সফলতার সাথে পাশ করল। লিনটেরিস আরও বলেন, "উুর তৈরি মাস্কের ডিজাইন খুবই ভালো ছিল। খুব সস্তা এবং সহজলভ্য বস্তু দিয়ে এই মাস্ক তৈরি করা যেত।" ১৯১১ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই মাস্ক তৈরি শতগুণ বেড়ে গেল। স্বাস্থ্যকর্মী, সৈনিকসহ সাধারণ লোকজনও এই মাস্ক পরা শুরু করল। ফলে প্লেগের দ্রুত বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে উুর মাস্ক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ১৯১৮ সালে যখন স্প্যানিশ ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন বিভিন্ন কোম্পানি উুর মাস্কের আদলে মাস্ক তৈরি শুরু করে।

গ্যাস মাস্ক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্যাস মাস্ক তৈরি করা হয় যা খনির শ্রমিকরাও ব্যবহার শুরু করে। এগুলো পুনরায় ব্যবহার করা গেলেও ফাইবারগ্লাস ফিল্টার এবং ভারী রাবারের বস্তু থাকার কারণে ব্যবহারকারীদের কাছে গ্যাস মাস্ক খুবই অস্বস্তিকর এবং ভারী লাগত।

এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক

১৯৫৮ সালে ডিজাইনার সারা লিটল টার্নবুল ‘থ্রি এম’ কোম্পানিতে একটি প্রেজেন্টেশন দেন, যাতে তিনি নন উভেন প্রোডাক্টের দিকে কোম্পানির ব্যবসা প্রসারিত করতে বলেন। তিনি একশটি পণ্যের ধারণা দেন এবং যার মধ্য থেকে তাকে মোলডেড ব্রা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে টার্নবুলকে পরিবারের অসুস্থ সদস্যদের দেখাশোনা করার জন্য হাসপাতালে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে তিনজন কাছের মানুষকে হারান তিনি। এই দুঃখবোধ থেকে বের হয়ে ‘বাবল’ সার্জিক্যাল মাস্ক নামে নতুন একটি মাস্ক উদ্ভাবন করেন টার্নবুল, যা দেখতে ছিল ব্রা কাপের মতো।
১৯৬১ সালে ‘বাবল’ সার্জিক্যাল মাস্কটি থ্রি এম কোম্পানি বাজারে ছাড়ে। যখন কোম্পানি বুঝতে পারল এই মাস্কটি জীবাণু প্রতিরোধ করতে পারবে না, তখন এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ডাস্ট’ মাস্ক।

১৯৭০ সালে খনি দপ্তর এবং জাতীয় পেশাগত সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান একবার ব্যবহার করা যায় এমন রেস্পিরেটরের মানদণ্ড তৈরি করে। সর্বপ্রথম থ্রি এম কোম্পানি এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক তৈরি করে, যা ১৯৭২ সালের ২৫ মে অনুমোদন পায়।
এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক মূলত কারখানায় ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার সাই এন নাইন্টি ফাইভ মাস্কে ভাইরাস প্রতিরোধী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন এবং ১৯৯৫ সালে এটি প্যাটেন্ট করান। এরপর থেকে এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক স্বাস্থ্যখাতে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

‘এন নাইন্টি ফাইভ’ নামকরণের কারণ
এন: ‘নট রেজিস্ট্যান্ট টু অয়েল’ বোঝাতে এন অক্ষরটি ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এই মাস্কটি কেবল বস্তু কণা প্রতিরোধ করবে, কোনো তরল নয়।

নাইন্টি ফাইভ: এই মাস্ক বাতাসে ভাসমান ৯৫ শতাংশ কণাকে ছাঁকতে পারে বিধায় নামকরণে ‘নাইন্টি ফাইভ’ ব্যবহার করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক। এই যুদ্ধ শেষে মাস্কটির ভূমিকা ঠাই পাবে ইতিহাসের পাতায়।  

POST COLLECT FROM: FB PAGE CARHIB BD

Post a Comment

0 Comments